Home Bangladesh যাদের শেষ কৌশলে পরাজিত হতে শুরু করে শত্রুরা

যাদের শেষ কৌশলে পরাজিত হতে শুরু করে শত্রুরা

53
0

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বিবিসি’র খবরে বলা হয়—ঢাকা শহর ঘিরে রেখেছে মুক্তিবাহিনীর ৮ হাজার  সদস্য। তারা বিচ্ছিন্নভাবে গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছে, যেকোনও সময় একসঙ্গে শহরে প্রবেশ করতে পারে। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, তাদের ঢাকায় ঢোকার পরিকল্পনা ছিল না। ঢাকার চারপাশে তারা নিজেদের আস্তানা গেড়েছিলেন। এটাই ছিল শেষ সময়ের কৌশল। আর এই কৌশলে যারা অংশ নিয়েছেন, তারা সবাই ‘গেরিলা’।

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শাহাদাত চৌধুরী যুদ্ধের পরের বছর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন সেসব দিনের পরিকল্পনার কথা। তিনি বলেন, ‘নভেম্বর থেকে ঢাকাকে ঘিরে তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়। মানিক গ্রুপ সাভার অঞ্চলে আর এদিকে ক্র্যাক প্লাটুন। তারা বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়েছিল স্থানীয় পাঠশালাগুলোতে, যেখানে তারা থাকতো। এই পতাকাকে কেন্দ্র করে পাক সেনারা আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামাতে চেষ্টা করেও পারেনি। পুরো রূপগঞ্জ থানা তখন গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত। শীতলক্ষ্যার পাড় ধরে মিলগুলো ছিল আর্মিদের বাংকার। তারা গেরিলা আক্রমণে আস্তে আস্তে সেসব এলাকা থেকে কেটে পড়তে থাকে।’

কীভাবে মানুষের সঙ্গে মিশে গেরিলারা কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতো, সেই কথা লিখতে গিয়ে শাহাদাত চৌধুরী বলেন, ‘ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ মেজর হায়দার একা এসে পৌঁছান। রূপগঞ্জ এলাকার এনফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল সফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা হয় তার, শীতলক্ষ্যার তীরে। হায়দারকে সফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করেন—তোমার ছেলেরা এখানে এভাবে ঘোরাফেরা করছে কেন? মেজর হায়দার বলেন, স্যার, এরা কয়েক মাস ধরেই এখানে আছে। ওদের সব চেনা। মানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ করছে গেরিলারা। প্রত্যেকটা ঘরে ছিল তাদের ঠাঁই। লোকের বিশ্বাসই তাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে শত্রুকে পরাজিত করার। গ্রামবাসী তাদের ভেতর জাগিয়ে দিয়েছে দায়িত্ববোধ।’

১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই গেরিলাদের অবদান ছিল অনেক বেশি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন মূল সড়ক, জাহাজ ও শহরে আস্তানা গাড়তো—তখন গেরিলারা অস্ত্র আর গ্রেনেড হাতে নিয়ে লুকিয়ে থাকতো নৌকার ছইয়ের ভেতর। রাতের আঁধারে মাইন নিয়ে সাঁতরে গিয়ে সেটা লাগিয়ে দিয়ে আসতো পাকিস্তানিদের জাহাজে। অতর্কিত হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দিতো ব্রিজ ও রেলপথ।

এসব করতে গিয়ে সহযোদ্ধা অনেককে হারানোর বেদনার কথা বলেন গেরিলা যোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদ। তিনি বলেন, ‘কোনও একটা অপারেশনের জায়গা ঠিক হওয়ার আগে—সেটা রেকি করা হতো, ইনফর্মার থাকতো, তারা পরিস্থিতি জানাতো। কাজটা হয়তো করতো কয়েকজন মিলে। আমাদের ইনফর্মার হিসেবে কাজ করতেন পাটবোঝাই নৌকার মাঝিরা। ব্রিজগুলোর ওপর রাতে রাজাকাররা পাহারা দেয়। তাদের ভেতরও আমাদের লোক ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। তারা যখন দেখতেন, পাকিস্তান আর্মি আশপাশে নেই, তখন পাকিস্তানের পক্ষে নানা স্লোগান দিলেই আমরা সিগন্যাল পেয়ে যেতাম যে ওইপথে এগোনো যাবে। একবার হলো কী—পাকবাহিনী আমাদের এই কৌশল জেনে গেলো। সেদিন সেই ব্রিজে যারা পাহারায় ছিল, তাদের সবাইকে হত্যা করে পাক সেনারাই সেখান থেকে স্লোগান দিলে, আমরা এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। ফরিদপুরের একটা দল ছিল আমাদের সামনের নৌকায়। রওনা দেওয়ার পর ব্রিজের কাছে গিয়ে আক্রমণের শিকার হয়। সেদিন আমরা অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে হারাই।’

রাজধানীকেন্দ্রিক গেরিলা যোদ্ধাদের বড় দলটি আটক হয় ৩০ আগস্ট ভোরে। রাজারবাগের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় সংগীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদ, লিনু বিল্লাহ, আবুল বারক আলভীসহ মোট ১২ জনকে। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের ধরতে এটিই ছিল হানাদার বাহিনীর সবশেষ অপারেশন। আগের দিন থেকে চলমান পাকিস্তানি বাহিনীর সেই চিরুনি অভিযানে একে একে ধরা পড়েছিলেন বদি, রুমি, আজাদ, জুয়েল, সৈয়দ হাফিজুর রহমান, আবু বকরসহ ৩০-৩৫ জন গেরিলা ও তাদের স্বজনরা।

পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হয়ে নির্যাতনের শিকার ও পরে মুক্ত আবুল বারক আলভী বলেন, ‘প্রচণ্ড নির্যাতনে আমরা কেউ মুখ খুলিনি। মার খেতে খেতে একসময় অনুভূতি মরে গেছে, গায়ে ব্যথা লাগে না। এরপরেও কেউ মুখ খুলেনি। কিন্তু অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বাকের মুখ খুলেছিল। আমার নামের সঙ্গে তালিকায় থাকা নামের কোনও একটা অমিল থাকায় সৌভাগ্যক্রমে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কেবল গেরিলা বলেই হয়তো আবারও ফিরে যাই যুদ্ধ ক্যাম্পে। কিন্তু যেহেতু আমার চেহারা তখন চেনা, সে কারণে আমাকে আর কোনও অপারেশনে পাঠানোর সুযোগ ছিল না।’

কিন্তু নভেম্বর থেকেই রাজধানীর চারপাশ ঘিরে গেরিলারা অবস্থান নেয়। শাহাদাত চৌধুরীর লেখায় পাওয়া যায় সে কথা। খালেদ মোশাররফের বরাত দিয়ে তিনি বলছেন, বারবারই বলা হতো—শহরে যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। শত্রুকে শুধু জানিয়ে দাও তোমরা আছো। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা থেকে কয়েকটি দুঃসাহসিক গেরিলা প্লাটুনকে প্রত্যাহার করা হয়। কারণ, এদের কিছু যোদ্ধা ধরা পড়েন শত্রুর হাতে।

গেরিলা যোদ্ধাদের কৌশল নিয়ে বলতে গিয়ে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘গেরিলাদের মূল কৌশল ছিল—কোনও একটি জায়গায় চটজলদি অপারেশন করা। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে লক্ষ্যে আক্রমণ এবং সেখান থেকে দ্রুত সরে পড়া। তাদের হামলা এতটাই অতর্কিতে হতো যে আগে থেকে আন্দাজ করা মুশকিল ছিল। বিজয়ের আগে গিয়ে শহরের চারপাশে দলগতভাবে যে গেরিলা উপস্থিতি ছিল, সেই ফাঁদে পা দিয়ে অনেক শত্রু অফিসার আক্রান্ত হয়েছে। কৌশল বুঝতে না পেরে তাদের নিশ্চল হয়ে যেতে দেখে যোদ্ধারা বুঝতে পারছিল, আর তাদের ক্ষমতা নেই। বিজয় আসন্ন।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here