নেটফ্লিক্সে ঝড় তোলা সিরিজ স্কুইড গেম। শৈশবের কিছু খেলা নিয়ে জনপ্রিয় কোরিয়ান সিরিজ এটি। নিতান্তই ছেলেমানুষী সব খেলা। দড়ি টানাটানি, সাইজমতো ক্যান্ডি কাটা, থেমে থেমে দৌড়ানো এসব। সিরিজ হিট হয়েছে কারণ এর খেলাগুলোর সঙ্গে স্থানীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতির এক ধরনের মিল পেয়েছেন দর্শকরা—খেলায় যে হারবে তাকেই মরতে হবে। শেষ পর্যন্ত যে জিতবে সে পাবে কাড়ি কাড়ি টাকা। সম্প্রতি বিশ্বকে গণতন্ত্র শেখাতে কোচিং সেন্টার খুলে বসা আমেরিকা ও চীন এখন দল ভারী করতে খেলতে শুরু করেছে ‘স্কুইড গেম’। দুই পক্ষই জানে, গণতন্ত্রের এ খেলায় হেরে যাওয়া মানে অর্থনৈতিক ও বিশ্ব রাজনীতির আসরে বেজে যাবে বিদায় ঘণ্টা।
দড়ি-টানাটানি
গণতন্ত্র কাকে বলে বা গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াটা কেমন, এ প্রশ্নের উত্তর কেউ খুঁজতে গিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভার্চুয়াল সম্মেলনে। তার আগে তড়িঘড়ি করে একের পর এক নিবন্ধ, খবর ও স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্টের বাণ ছুড়ে সম্মেলনের বারোটা বাজাতে চেয়েছিল শি জিনপিংয়ের একদলীয় সরকার। এখনও দড়ির টান দুদিকে সমানে সমান। কেউ কারও জাদুটোনায় কব্জা হচ্ছেন না সহসা।
শেষ পর্যন্ত চীনের কাছ থেকে গণতন্ত্র শিখতে হবে? সম্মেলনের আড়ালে এ প্রশ্নে সয়লাব ছিল অ্যান্টি-চীন জোট। কেউ আবার চোখ কুঁচকে ভাবছে, সাড়ে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি জিডিপি নিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের সিস্টেমে এমন কী আছে যে তারা এখন নিজেদের গণতান্ত্রিক বলেও দাবি করছে? গণতন্ত্রটা কেমন হলে ভালো হতো?
বাইডেনের সম্মেলন নিয়ে চীনের সরব বিরোধিতার আরেকটা কারণ পরিষ্কারই ছিল। সেটা হলো তাইওয়ানের অংশগ্রহণ। গণতন্ত্রের এ সম্মেলনে চীন-রাশিয়া দাওয়াত পায়নি, পেয়েছে তাইওয়ান। হাতেগোনা ১৫টি দেশের স্বীকৃতি পাওয়া তাইওয়ানকে তো চীন নিজের অংশ বলেই দাবি করে। সেখানে এ সম্মেলনে তাইওয়ানকে ডাকা মানে চীনের অহংবোধে নিদারুণ আঘাত বটে। আর তাই চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিও (সিসিপি) তড়িঘড়ি চেয়েছে বিশ্বকে গণতন্ত্রের একটা নতুন ফর্মুলা খাওয়াতে। আগের ফর্মুলায় যে হাজারো ফাঁক-ফোকর আছে সেটা নিয়েও ফলাও করে এটা-ওটা প্রচার করে চলেছে ওরা। সিসিপির মতে, চীনের মতো শনৈ শনৈ উন্নতি করতে চাইলে বিশ্বকে এখন গণতন্ত্রের মেড ইন চায়না ভার্সনটাই নিতে হবে। আমেরিকার মতো সিঁধ কেটে গণতন্ত্র চালান করার নীতি মেনে নিলে দিন শেষে নিজেদের কোনও ফায়দা হবে না।
ডেমোক্রেসি সামিটের পর তো চীনের পররাষ্ট্র দফতর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েই বললো, “বৈষম্যের আগুনে ক্রমাগত ঘি ঢালা ও গণতন্ত্রের নামে আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে আসাটা ইতিহাস কখনই ভালো চোখে দেখেনি। এতে বিশ্বের ক্রমাগত অশান্তি ও দুর্যোগই পেয়েছে। অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের রাজনৈতিক সিস্টেম ও আদর্শ অন্যের মাঝে পুরে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার’ আনতে গিয়ে উল্টো একপেশে অবরোধের চর্চা চালিয়েছে ও পক্ষান্তরে বর্ণবাদকেই উসকে দিয়েছে। অন্যের দেশে ব্যাপক হারে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে তাদের কাছে গণতন্ত্রটা হলো এক ধরনের অস্ত্র।”
চীনের পকেটে কত মারবেল?
চীন এতদিন প্রকাশ্যে গণতন্ত্র শব্দটি উচ্চারণ না করলেও এখন গোটা দুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে চলাটা যে জরুরি, সেটা পরিষ্কার টের পেয়েছে। ফরেন পলিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সম্মেলনের তাইওয়ানের যোগদানও এখানে তাই বড় ইস্যু নয়। ২০১৮ সালে যখন আমেরিকা একবার মোটামুটি ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লো তখন শি জিনপিং তার দলীয় সভায় বলেছিলেন, ‘এমন কিছু পরিবর্তন আসতে চলেছে, যা গত এক শতাব্দিতে লোকজন দেখেনি।’ চীনের অর্থনৈতিক উত্থানই ছিল জিনপিংয়ের ওই কথার বড় ইঙ্গিত। আর এটাকে ঘিরে মূলত নিজেদের বলয়টাকে বাড়ানোই হলো এতসব তন্ত্রমন্ত্রের সারকথা।
তবে ইদানিং চীন যে গণতন্ত্রের কথা বলছে, সেটাকে আপেক্ষিক একটা তন্ত্র-তত্ত্বে ফেলা যায় বটে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদের গণতান্ত্রিক চর্চার নানা ধরনের ব্যর্থতাকে তুলে ধরেই নিজেদের একদলীয় ‘গণতন্ত্র’কে হাইলাইট করছে দেশটি। ভিয়েতনাম থেকে শুরু করে, ইরাক, আফগানিস্তান, ইসরায়েল ও সাম্প্রতিক বর্ণবাদকে ঘিরে যত রায়ট; হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে উদাহরণ। আর এ সবের ওপর ভিত্তি করেই চীনের এক দলীয় ‘গণতন্ত্রের’ প্রতি বিশ্বের একটা অংশের আস্থা বাড়ছে, এমনটাই ভাবছে সিসিপি। যে কারণে তারা এখন আগের চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাসী। সেই আত্মবিশ্বাসের জেরে ভারতের সঙ্গে সীমান্তে আরও বেশি আগ্রাসী মনোভাবও দেখাচ্ছে চীন, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধও দিয়েছে। আবার তাইওয়ানের সঙ্গে কেউ সম্পর্ক পাতাতে এলে তাকেও চোখ রাঙাচ্ছে একচোট।
এদিকে চীন যে কেবল প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আছে তা নয়, তারা তাদের দেশ পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কেও বিশ্বকে জানাতে চায়। এতদিন রাখঢাক রাখলেও চীন এখন বিশ্বকে জানাতে চাইছে, তাদের একটা বহু বছরে গড়া গণতন্ত্র আছে। যেটাকে তারা নাম দিয়েছে ‘কনসালটেটিভ ডেমোক্রেসি’ বা ‘হোল প্রসেস ডেমোক্রেসি’। ব্রিটিশ থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অন জিওস্ট্র্যাটেজি’র গবেষক চার্লস পারটনও ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, ‘এক দশক আগেও বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বদলানো নিয়ে চীনের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয় তারা এখন সত্যিকার অর্থেই বিশ্বের রাজনৈতিক আদর্শের খোলনলচে বদলে দিতে আগ্রহী।’ পারটন আরও বললেন, চীনের এমন কথাবার্তা পশ্চিমের পর্যবেক্ষকরা উড়িয়ে দিলেও চীনারা কিন্তু ঠিকই গোগ্রাসে গিলছে। যে কারণে শি জিনপিং আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। চীন যত যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শে আঘাত হানবে, তত তাদের দেশের নাগরিকরাও কিন্তু নিজেদের সেরা ভাবতে শুরু করবে।
চীন বলছে, সমাজের সকল শ্রেণি থেকে মতামত নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নেয় তাদের গভর্নিং বডি সিসিপি। অ্যাঙ্গোলা, আর্মেনিয়া, আর্জেন্টিনাসহ এশিয়া, আফ্রিকার একগাদা উন্নয়নশীল দেশ, যারা ওয়াশিংটনের অ্যান্টি-চায়না জোটে ইতোমধ্যে মাথা সিঁধিয়ে দিয়েছে—তাদের মনে এসব বলে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিতে চাইছে চীন। তথাপি, সিসিপি কেন যায় না? বা আদৌ আর কোনও দল চীন শাসনের সুযোগ পাবে কিনা এসব নিয়ে চুপচাপ থেকে নিজেদের ‘কনসালটেটিভ গণতন্ত্রটা’কে ধোঁয়াশার ভেতর রেখেছে দেশটি।
পাল্টা চাল
এদিকে চীন যত বেশি আমেরিকা-বিরোধী কথাবার্তা ও হম্বিতম্বি করছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ছাতার নিচে বন্ধু সংখ্যাও বাড়ছে তত। বিষয়টা সিসিপির ভালোই জানার কথা। এ কারণে চীন সবাইকে এটাও বোঝাতে মরিয়া যে, ওয়াশিংটনকে দিয়ে আর বিশ্ব চলবে না। ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডেও ফাটল ধরা পড়েছে।
কিন্তু চীনের কথা শুনবে কে? এর মধ্যে অবশ্য আমাদের এ অঞ্চলের একজন ‘খেলোয়াড়’ কান দিয়েছে চীনা গুঞ্জনে। বাইডেনের সম্মেলনের দাওয়াত গ্রহণ করেও চীনের ফোন পেয়ে সেটা বাতিল করেছিল পাকিস্তান। সম্মেলনের আগের এক মধ্যরাতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ শাহমুদ কোরেশিকে কল করেছিলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ওয়াং ফোনে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ সম্মেলন গণতন্ত্রের জন্য করছে না, তাদের লক্ষ্য হলো সবার ওপর ছড়ি ঘোরানো। পাকিস্তানও অকপটে তা বিশ্বাস করে সম্মেলনে যোগ দেয়নি। পাকিস্তানের মতো এমন দ্বিধান্বিত দেশ যে আরও নেই তা কিন্তু বলা যাবে না।
আর এমন কিছু ‘সমর্থন’ পেয়ে চীন এখন তাদের ‘গ্লোবাল ডিসকোর্স পাওয়ার’ মতাদর্শটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে যতটা পারছে কলাম, প্রতিবেদন ও কার্টুন ছাপছে। যাতে তারা বলছে, চীনের আদলে গণতন্ত্র মেনে নিলেই বিশ্ব স্থিতিশীল হবে। বিশেষ করে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের জন্য এর বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মনোপলি নীতিও মাথা পেতে নেওয়াটাও বা কোন ধরনের গণতন্ত্র? এ প্রশ্নও চীনের।
কিন্তু দিন শেষে আরেকটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়, চীন কেন এভাবে আমেরিকান গণতন্ত্রের পিছু নিলো? গণতন্ত্র সম্মেলনে জো বাইডেন তো বলেই দিয়েছেন, এ সম্মেলন গণতন্ত্র নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠার জন্য নয়, এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্র আমাদের আরও ভালো কী দিতে পারে সেটা খুঁজে বের করা। এর জবাবে চীনের রা নেই। তাদের এতসব মরিয়া কর্মকাণ্ডেও এক ধরনের একনায়কগিরির ছাপ স্পষ্ট। সুতরাং এটা ধরে নিতে দোষ নেই যে, দিন শেষে চীন বলবে—গণতন্ত্র মানি, তবে তাইওয়ান আমার।