করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে চলমান কঠোর লকডাউনে প্রতিদিন কর্মস্থলে যান সাভার ও আশুলিয়ার কয়েক লাখ পোশাক শ্রমিক। জরুরি পণ্যবাহী ছাড়া সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন কর্মস্থলে যেতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় শ্রমিকদের। এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ থাকলেও চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খোলেন না শ্রমিকরা।
প্রতিদিন সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুর, নবীনগর-চন্দ্রা ও টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড, বাইপাইল ত্রিমোড়, সাভার বাসস্ট্যান্ড, রেডিও কলোনি, নবীনগর এলাকায় পোশাক শ্রমিকদের পরিবহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। একই চিত্র দেখা যায় জিরানী, শ্রীপুর, জামগড়া, শিমুলতলা, নরসিংহপুর ও উলাইল এলাকায়।
কঠোর লকডাউনের গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, এক রিকশায় পাঁচ জন, লেগুনা, ভ্যান কিংবা মিনিবাসে গাদাগাদি করে কর্মস্থলে যান শ্রমিকরা। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় রিকশা-ভ্যান ও লেগুনায় দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হয়। এরপরও এসব যানবাহনে উঠতে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে রিকশা-ভ্যানে চড়তে না পেরে হেঁটে কারখানায় যান হাজারো শ্রমিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভারে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিকের বাসা কারখানার আশপাশের এলাকায়। তবে ৩০ শতাংশ শ্রমিক দূরে বাসা নিয়ে বসবাস করছেন। হিসাবে দেখা যায় এদের সংখ্যা তিন লক্ষাধিক।
লকডাউন শুরুর আগে থেকে যেসব কারখানার পরিবহন ব্যবস্থা ছিল শুধু ওসব কারখানার শ্রমিকরা নিজস্ব পরিবহনে কর্মস্থলে যেতে পারেন। তবে এই কারখানার সংখ্যা হাতেগোনা। প্রতিবার লকডাউন শুরু হলে দুর্ভোগ ও ঝুঁকি বেড়ে যায় পোশাক শ্রমিকদের। এজন্য শ্রমিকরা লকডাউনের বিপক্ষে। কারণ তাদের জন্য কোনও ধরনের পরিবহন কিংবা যাতায়াতের ব্যবস্থা করে না কারখানা কর্তৃপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্টরা। নানা ভোগান্তি মাথায় নিয়ে কর্মস্থলে যেতে হয় তাদের।
পোশাককর্মী রহিমা আক্তার, শেফালি বেগম ও খোরশেদ আলমসহ কয়েকজন জানান, করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই কারখানার মালিকপক্ষকে যাতায়াতের ব্যবস্থা করার কথা বলেছি। তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি প্রয়োজনও মনে করেননি। এজন্য আমরা লকডাউন চাই না। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকলেও আমাদের কারখানা খোলা থাকে। কিছু বললে মালিকপক্ষ বলে চাকরি ছেড়ে দিতে। একদিন কাজে না এলে বেতন কাটে। বাধ্য হয়ে রিকশা-ভ্যানে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে কারখানায় আসি। আমাদের কষ্ট কেউ দেখে না, কেউ মূল্যায়ন করে না।
পোশাক শ্রমিক রায়হান আহমেদ বলেন, পোশাক শ্রমিকদের জীবনের কোনও দাম নেই। লকডাউনে পথে পথে ভোগান্তি। প্রতিদিন সকালে যুদ্ধ করে কারখানায় যেতে হয়। রিকশা-ভ্যানে গাদাগাদি করে যাতায়াত করি। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আছে ঠিকই। কিন্তু আমাদের জন্য কোনও ছাড় নেই। প্রতিবার লকডাউনে মালিকপক্ষকে পরিবহনের ব্যবস্থা করার কথা বললেও করে না। যে যেভাবে পারছে কারখানায় আসছে। আমাদের কথা মালিকপক্ষ যেমন ভাবে না তেমননি সংশ্লিষ্টরাও ভাবে না।
আশুলিয়ার গ্লোবাল নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানার পরিচালক রেজাউল কবির রাসেল বলেন, করোনার শুরু থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনা করে আসছি আমরা। সব শ্রমিকের মাস্ক পরা নিশ্চিত করেছি। কারখানায় রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত স্যানিটাইজার।
শ্রমিকদের পরিবহনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কারখানার অধিকাংশ শ্রমিক আশপাশের এলাকায় থাকেন। সে কারণে পরিবহনের প্রয়োজন হয়নি। তবে কিছু সংখ্যক শ্রমিক দূরে বসবাস করেন। তাদের সঙ্গে পরিবহনের বিষয়ে কথা হয়েছে। শ্রমিকরা প্রয়োজন মনে করলে পরিবহনের ব্যবস্থা করবো। কারখানার কোনও শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হলে ছুটি ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত আমার কারখানার কোনও শ্রমিক মারা যাননি। আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে অবশ্যই আমি সহযোগিতা করবো।
বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাকশিল্প শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সারোয়ার হোসেন বলেন, লকডাউনে পরিবহন সংকট থাকায় পোশাক শ্রমিকদের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে । যেসব কারখানায় আগে থেকে পরিবহনের ব্যবস্থা ছিল, শুধুমাত্র ওসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা নিজস্ব পরিবহনে কারখানায় যাতায়াত করতে পারছেন। বাকি কয়েক লাখ শ্রমিককে নানাভাবে ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। সব কারখানার শ্রমিকের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সঙ্গে সব পোশাক শ্রমিককে করোনার টিকা দেওয়ার দাবি জানাই। অন্তত কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকবে শ্রমিকরা।