বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবায়। দেশটির রাজধানী হাভানাজুড়ে রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। সাধারণ মানুষ এখানে সবসময় চিকিৎসা নিতে পারেন। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে একজন করে চিকিৎসক ও নার্স রয়েছে। তাঁদের সেখানে থেকেই চিকিৎসাসেবা দিতে হয়।
মঙ্গলবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই চিকিৎসক ও নার্সদের মানুষের বাড়ি বাড়ি যেতে হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা দিতে নয়, কিউবায় উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁদের এই ভ্রমণ। তাঁরা বাসিন্দাদের বোঝাচ্ছেন, পর্যাপ্ত সিরিঞ্জ রয়েছে, টিকা নিয়ে নেন। এ রকম চিত্র এখন প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে হাভানায়। কিছুদিন পর সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে এই কার্যক্রম।
করোনা মহামারির শুরুর পর আটলান্টিক পাড়ের দেশ কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থা বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। করোনার কোনো ঢেউই দেশটিকে কাবু করতে পারেনি। তবে সম্প্রতি দেশটিতে করোনা সংক্রমণের হার কিছুটা বাড়লে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে নয়। এর মধ্যে কিউবা এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশটি নিজেদের গবেষণাগারে পাঁচটি করোনার টিকা উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে একটি আবদালা। এই টিকাটি ৯২ দশমিক ২৮ শতাংশ কার্যকরী বলে কিউবার সরকার জানিয়েছে। তবে এটি তিন ডোজের। ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা ৯৫ শতাংশ, মডার্নার টিকা ৯৫ শতাংশ ও অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৭৬ শতাংশ কার্যকর বলে মানবদেহে পরীক্ষায় উঠে এসেছে। সেই তুলনায় আবদালা টিকার কার্যকারিতা কম নয়।বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া কিউবার উদ্ভাবিত সোবেরানা–০২ নামের আরেকটি টিকাও বেশ কার্যকর বলে দাবি করেছে দেশটির সরকার। চলতি মাসের প্রথম দিকে দেশটি জানায়, সোবেরানা–০২ টিকার দুই ডোজ নিলে ৬২ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা পাওয়া যাবে। গত বৃহস্পতিবার কিউবার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই টিকার বুস্টার ডোজ নিলে করোনা থেকে ৮৫ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা পাওয়া যাবে।
কানাডীয় আইনজীবী গ্রেগরি বিনোভস্কি দীর্ঘদিন হাভানায় থাকেন। সম্প্রতি সেখানকার একটি স্কুলে গিয়ে করোনার আবদালা টিকা নিয়েছেন তিনি। টিকা নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ সেখানে ছয়জন স্বাস্থ্যকর্মী ছিলেন। একজন নার্স বলেন, ফ্লুর মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। মাংসপেশিতে সামান্য ব্যাথাও হতে পারে। আমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।’
এসব টিকার মানবদেহে পরীক্ষার চালানো হয়েছে শুধু কিউবাতেই। এসব টিকার কার্যকারিতা এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে নিশ্চিতও করা হয়নি। তাই করোনার নতুন ধরনের ক্ষেত্রে টিকাটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। তবে যা–ই হোক না কেন, করোনা টিকা উদ্ভাবনকে সফলতা হিসেবেই দেখছেন অনেক কিউবান।
কিউবার গবেষণাগারের বিশেষজ্ঞ ও ব্রাজিলের সাও পাউলো ইউনিভার্সিটির মলিকুরার বায়োলজির ফেলো আমলকার পেরেজ রিভেরোল বলেছেন, ‘এখানে জালিয়াতি ও কারসাজি হয়েছে, এমনটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। এটা জৈবপ্রযুক্তির ব্যাপার। এটা কতটা কার্যকর সেটাই দেখার বিষয়। বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের একজন সদস্য হিসেবে আমি ডেটাকে গুরুত্ব দিতে চাই।’
করোনা মহামারি শুরু পর কিউবা স্বাস্থ্যখাতে নিজেদের দক্ষতা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার সুযোগ পায়। করোনায় খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করা কিছু দেশে চিকিৎসক–নার্স ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠায় দেশটি। দেশটির প্রয়াত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো দেশটির চিকিৎসাব্যবস্থায় কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেটাও প্রমাণের সুযোগ পায় তারা। সম্প্রতি গবেষণাগার পরিদর্শনে গিয়ে কিউবার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ–কানেল সেটাকেই ইঙ্গিত করলেন। তিনি করোনার এসব টিকাকে ‘সার্বভৌম টিকা’ হিসেবে অভিহিত করেন।বিজ্ঞাপন
১ কোটি ১২ লাখের মতো জনসংখ্যার কিউবায় এখন পর্যন্ত ২০ লাখের মতো মানুষ করোনা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কিউবার অধিকাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন গ্রেগরি। কিউবার এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজারের মতো মানুষ। মারা গেছেন ১ হাজার ২৫৩ জন।
কিউবার চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত তার প্রমাণ মেলে চিকিৎসকের সংখ্যায়। দেশটিতে প্রতি ১ হাজার জনের বিপরীতে আটজন চিকিৎসক রয়েছেন, যা যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তিন গুণ।