বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর যা রফতানি করে তা দেশটির মোট রফতানির শতকরা ৮০ ভাগ। করোনাভাইরাস মহামারী আঘাত হানার এক বছরেরও বেশি সময় পরে সেক্টরটি এখন বিদেশী খুচরা বিক্রেতাদের অর্ডার বাতিল এবং শিপিং বিলম্বের বিপর্যয় মোকাবেলা করছে।
গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো
- জাকিরুলের মতো বাংলাদেশ জুড়ে অসংখ্য কারখানায় ২০২০ সালে মহামারীর প্রাদুর্ভাবে বড় বিদেশী খুচরা বিক্রেতারা তাদের অর্ডার বাতিল করেছে এবং তারা সেই সাথে শিপিং বিলম্বের জটিলতা মোকাবিলা অব্যাহত রেখেছে।
- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশের ৩৫০,০০০ এরও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক এখনও পর্যন্ত মহামারীর মধ্যে চাকরি হারিয়েছে। এদিকে বিদেশের রিটেইল বায়াররাও পণ্য কিনছে বিচ্ছিন্নভাবে।
- অস্ট্রেলিয়ান বায়ার মোজাইক ব্র্যান্ড বলেছে যে তারা “শ্রমিকদের সুরক্ষা, আধুনিক দাসত্ব এবং এথিকাল সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ কয়েকটি সামাজিক সম্মতিমূলক পদক্ষেপসমূহ মেনে চলে”
সময়টা ২০২০ সালের ডিসেম্বর, মহামারী যখন সর্বোচ্চ চূড়ায় তার নয় মাস পরের কিছু ঘটনা।
বাংলাদেশের ঢাকার সদা চঞ্চল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বেল্টের মাঝে জাকিরুল আলমের ফ্যাক্টরি; সেখানে তিনি দেখালেন তার সারি সারি প্রোডাকশন লাইন অন্ধকারে নিষ্ক্রিয় পড়ে আছে।
“আমি আজকাল লাইটও চালু করতে পারি না কারণ আমি বিদ্যুৎ বিল দিতে পারি না,” তিনি বলেন।
জাকিরুলের ফ্যাক্টরিটি একসময় কয়েকশ পোশাক শ্রমিকে পূর্ণ ছিল; ডেটলাইনকে তিনি বলেন যে তার এখন অনেক ঋণ এবং তিনি বাধ্য হয়েই অনেককে ছাঁটাই করেছেন।
তাদের জায়গাটিতে রেডিমেইড জামাকাপড় ভর্তি বাক্সের স্তূপ পড়ে আছে, এর বেশিরভাগই অস্ট্রেলিয়ান খুচরা বিক্রেতা মোজাইক ব্র্যান্ডের জন্য বানানো।
জাকিরুল বলেন, “যদি এই পণ্যগুলো সময়মতো চলে যেত তবে আমি আজ এতো খারাপ অবস্থায় থাকতাম না।”
জাকিরুল আলম মোজাইক ব্র্যান্ডসহ বিদেশী খুচরা বিক্রেতাদের সরবরাহকারী। তাঁর কারখানাটি টি-শার্ট থেকে জিন্স পর্যন্ত সকল জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ান লেবেলের পোশাক তৈরী করে, যার মধ্যে আছে রিভার্স, মিলারস এবং কেটিস।
অস্ট্রেলিয়ায় কোভিড-১৯ এর সময়ে অনলাইন শপিং বেড়েছে
বিশ্বে অনেক স্টোর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং কোভিড ১৯-এর কারণে গ্রাহকের চাহিদা কমেছে। জাকিরুলের মতো বাংলাদেশ জুড়ে অসংখ্য কারখানায় ২০২০ সালে মহামারীর প্রাদুর্ভাবে বড় বিদেশী খুচরা বিক্রেতারা তাদের অর্ডার বাতিল করেছে এবং তারা সেই সাথে শিপিং বিলম্বের জটিলতা মোকাবিলা অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারিদের সংগঠন বিজিএমইএ অনুসারে, ২০২০ এপ্রিল পর্যন্ত আদেশ বাতিল বা বিলম্বিত শিপিঙয়ের জন্য দায়ী অস্ট্রেলিয়ান ব্র্যান্ডগুলির একটি দীর্ঘ তালিকা তাদের কাছে আছে যাদের রিপোর্ট করা হয়েছিল।
বিজিএমইএ বলেছে যে ২০২০ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী সব বায়াররা ১১০৫ টি কারখানার প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের আদেশ বাতিল করে যার মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশ পরে পুনঃস্থাপন করা হয়েছিল।
কিছু ক্রেতা বাতিল হওয়া অর্ডারগুলির ৮০-১০০ শতাংশ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তবে তাদের মধ্যে কিছু ফেরত নেয়নি। তাদের মধ্যে অনেকে ডিসকাউন্ট চেয়েছে এবং বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের সাথে বেশ দরকষাকষি করেছে।
জাকিরুল যা বলছেন
জাকিরুল বলেন মোজাইক ব্র্যান্ড একজন ভাল গ্রাহক ছিল এবং সাধারণত পেমেন্ট পরিশোধে খুব ভাল ছিল।
তবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে মহামারীর সময়ে, তিনি দাবি করেন যে তারা ইতিমধ্যে তৈরি প্রায় ৬০০,০০০ মার্কিন ডলারের পণ্য চালান স্থগিত করে এবং শিপিং বিলম্ব করে।
জাকিরুলের বলেন, মোজাইক ব্র্যান্ড ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এই শিপমেন্টগুলি নিয়ে যেতে শুরু করে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত, মহামারীটি আঘাত হানার এক বছরেরও বেশি সময় পরে, চূড়ান্ত চালানটি সম্প্রতি পাঠানো হয়েছে।
জাকিরুল বলেন যে এই সময়ে তার ব্যবসায় মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। তিনি এখন নিজের ব্যবসায় চালিয়ে যাওয়ার জন্য লড়াই করছেন।
যেহেতু শিপমেন্ট না হলে ব্র্যান্ডগুলো পণ্যগুলির জন্য অর্থ প্রদান করবে না, তখন কোন অর্ডার হোল্ড করা বা বাতিল করা হলে পেমেন্টগুলোও স্থগিত রাখা হয় বা বাতিল করা হয়।
জাকিরুলের মতো সরবরাহকারীদের অর্থপ্রদানের বিলম্ব হলে তারা ম্যাটেরিয়াল কেনার অর্থ বা তাদের শ্রমিকদের মজুরির জন্য অর্থ দিতে না পারার ঝুঁকিতে থাকতে হয়।
“আপনি জানেন যখন প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয় তখন কী হয়? ভূমিকম্পের পরে আপনি যেন দাঁড়িয়ে আছেন কোন ভগ্নস্তূপের মধ্যে, আমি এখন এই অবস্থার মধ্যে আছি,” তিনি বলেন।
‘কোন বিদেশি শক্তির পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করা কঠিন’
জাকিরুলের মতে মোজাইক ব্র্যান্ড তার অর্থপ্রদানের শর্তাবলীও পরিবর্তন করেছে এবং তার সাথে শিপমেন্ট হয়ে যাওয়ার পড় অর্থ প্রদানের সময়সীমা ৯০ দিন থেকে ১৭০ দিন বা প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
“ব্যাংক যদি আমাকে ঋণ না দেয় তাহলে আমি কিছুই কিনতে পারব না। আমি ফ্যাব্রিক কিনতে পারব না। আমি থ্রেড কিনতে পারব না। আমি আপনার এক্সেসরিজ কিনতে পারব না। আমি কিছুই করতে পারব না। ব্যাংক ব্যবসায়ের প্রধান স্তম্ভ,” জাকিরুল ডেটলাইনকে বলেন।
জাকিরুল দাবি করেছেন যে মোজাইক ব্র্যান্ড ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রায় ৫০০,০০০ ডলার মূল্যের অর্ডারও বাতিল করে দিয়েছিল, যা পুনর্বহাল করা হয়নি।
ডেটলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোজাইক ব্র্যান্ডের কমপক্ষে আরও দুটি সরবরাহকারী সাথে কথা বলেছে। তারা বলেছে যে মোজাইক ব্র্যান্ডের আদেশ বাতিলকরণ বা শিপিং বিলম্বের কারণে তারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
গত বছর অস্ট্রেলিয়ায়, স্মল বিজনেস অমবাডসম্যান পেমেন্টের শর্ত বাড়ানোর জন্য খুচরা বিক্রেতাদের সমালোচনা করেছিল। অমবাডসম্যানের কেট কার্নেল বলেছিলেন যে বড় কোম্পানিগুলো COVID-19 সঙ্কটকে পুঁজি করে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে এটিকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছে এবং তিনি ৩০ দিনের মধ্যে অর্থ প্রদানের শর্ত আইনীকরনের আহ্বান জানিয়েছেন।
কর্মীদের উপর প্রভাব
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর হিসেবে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প ৪.১ মিলিয়ন শ্রমিকের কর্মসংস্থান করেছে এবং এই সেক্টর থেকে দেশের মোট রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ আয় আসে।
কিন্তু প্রতি মাসে একের পর এক কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে এবং তারা শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে কোন অর্থ ছাড়াই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশের ৩৫০,০০০ এরও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক এখনও পর্যন্ত মহামারীর মধ্যে চাকরি হারিয়েছে। এদিকে বিদেশের রিটেইল বায়াররাও পণ্য কিনছে বিচ্ছিন্নভাবে।
জাকিরুল আলম যে শত শত পোশাক শ্রমিক বাধ্য হয়ে ছাঁটাই করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও তার কাছে বেতন পান।
“আমি সবসময় কাজে নিয়োজিত ছিলাম। তবে আমি গত তিন মাস ধরে ঘরে বসে আছি। বাড়িতে থাকতে আমার ভালো লাগছে না।” বলছিলেন ২৪ বছর বয়সী জেসমিন আক্তার।
তিনি জাকিরুলের কারখানায় পোশাক তৈরি করতেন, তবে সেপ্টেম্বর মাসে ফিনিশিং বিভাগে লাইন কর্মী হিসাবে চাকরি হারিয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি বেকার।
“সেপ্টেম্বরের পর থেকে বাড়ী ভাড়া প্রদান, খাবার কেনার বিষয়ে ভীষণ চিন্তা করছি। আমার বাবার চোখের অপারেশন হলে তার একটা চাকরি হতো, আমরা একটু আরও ভাল থাকতাম।
“আমি যদি ভাড়া না দিতে পারি তবে বাড়িওয়ালা আমাদের তাড়িয়ে দেবে। সে আমার কাছে তিন মাসের ভাড়া পাবে।
“মাসে ৩,০০০ টাকা (৪৬ ডলার), সব মিলিয়ে ৯,০০০ টাকা (১৪০ ডলার)।
“আমি আমার ভাইয়ের কাছে কিছু টাকা চেয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে এক পয়সাও দেয়নি… এখন সব দায়িত্ব আমার। আমি কখনই কোন কিছু বলি না কারণ আমার বাবা-মায়ের খারাপ লাগবে। আমি চলে গেলে কে তাদের দেখাশোনা করবে?” কাঁদতে কাঁদতে জেসমিন বলে।
ওয়ার্কার রাইটস কনসোর্টিয়াম (ডাব্লুআরসি) এর মতে, কিছু পোশাক শ্রমিক পুরো বছর বকেয়া মজুরির জন্য অপেক্ষা করেছে এবং তারা তাদের সন্তানদের অভুক্ত রেখেছে।
ডাব্লুআরসি’র নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বের প্রায় দশ হাজার পোশাক শ্রমিক সবমিলিয়ে এখনও ৩৯.৮ মিলিয়ন ডলার আইনসম্মতভাবে ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু আইন লঙ্ঘন করে এবং ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতারা তাদের শ্রম অধিকারের বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী তারা সে অর্থ এখনো বাকি রেখেছে।
বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে রয়েছে এই শীর্ষস্থানীয় গার্মেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, তারা এখন কোভিড ১৯ সহায়তা বাড়ানোর দাবি করছেন।
মোজাইক ব্র্যান্ডের প্রতিক্রিয়া
ডেটলাইন মোজাইক ব্র্যান্ডকে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য অনুরোধ করলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
তবে জাকিরুলের দাবির লিখিত জবাবে, এই রিটেইল কোম্পানী অস্বীকার করেনি যে তারা ২০২০ সালের মার্চ মাসে শিপমেন্ট চালান বিলম্ব করেছিল, যার ফলে জাকিরুলের কারখানায় অর্থ প্রদান বিলম্বিত হয়েছিল। তারা এটাও অস্বীকার করেনি যে ৫,০০,০০০ মার্কিন ডলারের অর্ডার বাতিল করা হয়েছিল।
তবে তারা যুক্তি দিয়ে বলেছে যে জাকিরুলের কোন আর্থিক ব্যয় বা দায় ছিল এবং বলেছে যে তিনি বাতিলের আবেদন করেছিলেন। তবে এমন দাবি জাকিরুল অস্বীকার করেন।
মোজাইক ব্র্যান্ডস জানিয়েছে যে ২০২০ সালের জানুয়ারির পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তাদের মোট অর্ডারগুলো তার কারখানার বার্ষিক উৎপাদনের ১০ শতাংশেরও কম।
তবে জাকিরুল দাবি করেছেন যে এটি বিভ্রান্তিকর কারণ এই হিসাব সর্বাধিক উৎপাদনের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে, কারখানাটি ২০২০ জুড়ে যে অর্ডার পেয়েছে তার উপর ভিত্তি করে নয়। তিনি দাবি করেন যে মোজাইক ব্র্যান্ডই তাদের অন্যতম বৃহত্তম গ্রাহক।
কোম্পানীটি আরও বলেছে যে তারা “শ্রমিকদের সুরক্ষা, আধুনিক দাসত্ব এবং এথিকাল সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশ কয়েকটি সামাজিক সম্মতিমূলক পদক্ষেপসমূহ মেনে চলে” এবং ২০২০ সালের জন্য তারা তাদের আধুনিক দাসত্ব বিবৃতিটির (মডার্ন স্ল্যাভারি স্টেটমেন্ট) একটি অনুলিপি দিয়েছে।
কোম্পানীটি আরও বলেছে: “বিশ্বব্যাপী মহামারীর প্রতিক্রিয়ার ১২ মাস পরেও কোভিড-পূর্ব বাংলাদেশের যে প্রস্তুতকারকরা মোজাইক ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করেছিলো তারা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।”