চট্টগ্রামের নতুন নগরপিতা রেজাউল করিম চৌধুরী

    203
    0

    নতুন নগরপিতা পেলেন চট্টগ্রাম মহানগরের বাসিন্দারা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন তিন লাখ ৬৯ হাজার ২৪৮ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট।

    বুধবার দিবাগত রাতে নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়ামে ভোটের বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান।

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মোট কেন্দ্র ৭৩৫টি। এর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে দুটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।

    বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলে। ভোট চলাকালে দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিতে একজন নিহত হওয়া ছাড়াও ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে ভাই নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

    ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনা শুরু হয়। গণনা শেষে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেই ফলাফল চলে আসে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়ামে ভোটের বেসরকারি ফল ঘোষণা করেন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা।

    ভোটে সহিংসতা

    চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পঞ্চম নির্বাচিত পরিষদের মেয়াদ শেষের আগে গত বছরের ২৯ মার্চ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে দলীয় মনোনয়ন পর্যন্ত সবই সম্পন্ন হয়। করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মাত্র কয়েক দিন আগে স্থগিত করা হয় নির্বাচন। পরে ভোটগ্রহণের জন্য বুধবারের দিন নির্ধারণ করা হয়।

    এদিন সকালে ভোটের শুরুটা হয়েছিল ভালোই। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে খুলশী ইউসেপ স্কুল কেন্দ্রে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে আলাউদ্দিন আলো (২৮) নামের একজন নিহত হন। পরে এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. জহির এনটিভি অনলাইনকে জানান, নগরীর খুলশী আমবাগান এলাকার ইউসেপ স্কুল কেন্দ্র থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হলে আলাউদ্দিন আলোর মৃত্যু হয়।

    এদিকে নগরীর ১২ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের বার কোয়ার্টার এলাকায় আপন ভাইয়ের হাতে আরেক ভাই খুন হয়েছেন। নিহত নিজাম উদ্দিন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী সাবের আহমেদের কর্মী বলে জানা গেছে। নিজাম উদ্দিনের ভাই সালাউদ্দিন কামরুল একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী নুরুল আমিনের কর্মী। নির্বাচন নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে কিছুদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। সকালে ভোট শুরুর আগেই দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হলে মুন্নাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান কামরুল। তবে পারিবারিক বিরোধ নাকি রাজনৈতিক বিরোধের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা এখনো নিশ্চিত নয়।

    এদিকে নির্বাচনে ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে কয়েকটি কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনার পর বিএনপির কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মোহাম্মদ ইসমাইল বালীকে আটক করেছে পুলিশ। পাথরঘাটা মহিলা কলেজ কেন্দ্রে নির্বাচনি কর্মকর্তা আহতের ঘটনায় তাঁকে আটক করা হয়েছে।

    পাথরঘাটা ছাড়াও ১৪ নম্বর লালখান বাজার এলাকাতেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখানে প্রায় ২০ জন আহত হয়েছে।

    আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বুধবার সকাল ৯টার দিকে বহদ্দারহাট এখলাছুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দেন। পরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভালো ভোট হচ্ছে। নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান করছেন ভোটারেরা। উৎসবমুখর পরিবেশ ভোট দিচ্ছেন সবাই।’

    এ সময় বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে নৌকা মার্কার প্রার্থী বলেন, ‘বিএনপির এজেন্টরা কেন্দ্রেই যায়নি। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন। এজন্য তারা এজেন্ট দিতে পারেনি।’

    এদিকে বিকেলে ভোটের পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নির্বাচন বানচালে বিএনপির অপপ্রয়াস ভণ্ডুল করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

    বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন বেলা ১১টার দিকে নগরের চকবাজার টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (বিএড কলেজ) ভোট দেন। এরপর তিনি গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, ‘সব কেন্দ্র থেকে দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও এজেন্টদের মেরে বের করে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন নির্যাতনে পরিণত হয়েছে।’

    ভোট শেষে বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির দলীয় কার্যালয় নাসিমন ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশ, আওয়ামী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী এই নির্বাচনী প্রজেক্টের আওতায় আজকের মেয়র নির্বাচনে সেই কাজগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।’

    ‘নির্বাচনই তো হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে নির্বাচন করলে বলা যেত নির্বাচন হয়েছে। এজেন্ট বের করে দেওয়ার মূল কাজটি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’, যোগ করেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা।

    এদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব মোহাম্মদ আলমগীর। বুধবার বিকেলে নির্বাচন ভবনে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বলব যে, ভালো নির্বাচন হয়েছে। তবে দুটি কেন্দ্রে শুধু, বিশৃঙ্খল লোকজন যারা ইভিএমের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট নাই, ইভিএমে ভোট হোক তারা চায় না, তারা সেখানে আক্রমণ চালিয়েছে। সেখানে ইভিএম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুটি কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত করেছি।’

    ‘এ ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোতে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন হয়েছে। এবং অত্যন্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে জনগণ যারা ভোট দিতে আসছিল তারা ভোট দিয়ে গেছে’, যোগ করেন ইসি সচিব।

    মেয়রপদে যারা অংশ নিয়েছেন

    আওয়ামী লীগ মনোনীত এম রেজাউল করিম চৌধুরী (নৌকা), বিএনপি মনোনীত ডা. শাহাদাত হোসেন (ধানের শীষ), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মাওলানা এমএ মতিন (মোমবাতি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আবুল মনজুর (আম), ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী (হাতি)।

    ভোটের অন্যান্য তথ্য

    ‌এই নির্বাচনে ১৪ সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রার্থী রয়েছেন ৫৭ জন। সাধারণ ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৯ ওয়ার্ডে। ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আর ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিম মৃত্যুবরণ করায় ওই পদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। তবে ওই ওয়ার্ডে মেয়র ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসেন মুরাদ ইন্তেকাল করলে সেখানে আবদুল মান্নানকে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

    ১৮ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

    ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় নয় হাজার পুলিশ-আনসারের পাশাপাশি মোতায়েন ছিল ২৫ প্লাটুন বিজিবি, ২৫ প্লাটুন র‍্যাব, স্ট্রাইকিং ফোর্সসহ মোট ১৮ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এ ছাড়া যে কোনো ধরনের অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচারের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ছিল ২০ জন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট।

    এর পাশাপাশি ভোট গ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন ১৬ হাজার ১৬৩ জন কর্মকর্তা। সবাই ইভিএম বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এর মধ্যে রয়েছেন প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা পাঁচ হাজার ৯০২ জন এবং পোলিং কর্মকর্তা ১০ হাজার ২৬৮ জন।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here