ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বেআইনিভাবে কয়েকশো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে টানা ২৭ ঘণ্টা জেরার পর অবশেষে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী তথা রাজ্যের বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। এর আগে গতকাল তার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতারের আগে তার এক সহযোগির বাড়ি থেকে প্রায় ২১ কোটি রুপি উদ্ধার করা হয়।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডির দাবি, দক্ষিণ কলকাতায় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে প্রায় ২১ কোটি রুপি নগদ পাওয়া গিয়েছে। দু’বস্তায় ভরা ছিল ২০০০ এবং ৫০০ রুপির নোটের বান্ডিল। পাওয়া গেছে ৭৯ লাখ রুপির গয়না এবং ৫৪ লক্ষ রুপি মূল্যের বিদেশী মুদ্রা। ওই বাড়ি থেকে ২০টি মোবাইল ফোনও পাওয়া গিয়েছে বলে ইডির দাবি। ইডি সূত্রের খবর, ওই অর্থ স্কুলে বেআইনি নিয়োগে নেওয়া ঘুষের অংশ বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করছে তারা।
এদিকে গ্রেফতার হবেন জেনে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গেকর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি যোগাযোগ করতে পারেন নি। শনিবার গ্রেফতারের এবং মেডিক্যাল চেকআপের পর ইএসআই হাসপাতালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব নিজের মুখেই জানিয়েছেন তা। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেফতার নিয়ে তাঁর সঙ্গে তৃণমূল বা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা হয়েছে কিনা। আর তার উত্তরে পার্থ চট্টোপাধ্যায় শুধু একটা কথা বলেছেন: যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পাই নি।
উল্লেখ্য, সাড়ে ২৭ ঘণ্টার দীর্ঘ জেরা পর্বে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে সেভাবে তৃণমূলের কাউকেই দেখা যায় নি।
অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়ে দিয়েছেন ইডি যে অর্থ উদ্ধার করেছে তার সঙ্গে তৃণমূলের কোনও সম্পর্ক নেই। এই তদন্তে যাদের নাম আসছে, এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের বা তাঁদের আইনজীবীদের। কেন দলের নাম জড়িয়ে প্রচার চলছে, তা দল নজর রাখছে জানিয়ে কুণাল ঘোষের বক্তব্য যথাসময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে সব জানানো হবে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পর গ্রেফতার করা হয়েছে তার বান্ধবী বলে কথিত অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে। প্রথমে ইডির তরফে জানানো হয়েছিল আটক করা হয়েছে অর্পিতাকে। অর্পিতার পেশা নিয়ে বিভ্রান্ত্রি রয়েছে বিভিন্ন মহলে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পুজো বলে বিখ্যাত দক্ষিণ কলকাতার নাকতলার পুজোয় অর্পিতাকে মডেল দেখা গেলেও কোনও কোনও মহল থেকে তাকে আইনজীবী বলা হচ্ছে এবং দক্ষিণ কলকাতার এক প্রোমোটারের শ্যালিকা হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, অর্পিতা রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী তথা প্রাক্তন শিক্ষা এবং তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ। দু’জনের একসঙ্গে বেশ কিছু ছবিও নেটমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ভোটের প্রচারেও তাঁদের এক গাড়ি থেকে হাত নাড়তে দেখা গিয়েছে। ২০০৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম বাংলা ছবি, পার্টনার। সেই সিনেমায় ছিলেন টলি অভিনেতা জিৎ। ২০০৯ সালে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মামা-ভাগ্নে ছবিতে অভিনয় করেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। ওড়িয়া, মালায়লম এবং দক্ষিণের বেশ কিছু ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। সেই সঙ্গে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনেরও মুখ ছিলেন অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘের দুর্গাপুজোর মুখ ছিলেন তিনি। অর্পিতা মুখোপাধ্যায় নিজে অভিনেত্রী এবং মডেল বলে দাবি তাঁর এবং তাঁর মায়ের।
এর মধ্যেই খবর, নিউ ব্যারাকপুরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রাক্তন শিক্ষমন্ত্রীরই আপ্ত সহায়ক সুকান্ত আচার্যকে। তাকেও ইডির হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে যদি সূত্রের খবর, পার্থ -সুকান্ত এবং অর্পিতাকে মুখোমিখি বসিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
অন্যদিকে, তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আরেক ঘনিষ্ঠ মোনালিসা দাসকেও খুঁজছে ইডি। আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপিকা এসবি গড়াই রোডের বিবেকানন্দ পল্লীর যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেখানে গত দু’সপ্তাহ ধরে তিনি আর যাচ্ছেন না। ইডি সূত্রে খবর, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা মোনালিসা বেশিরভাগ দিন শান্তিনিকেতনে থাকতেন, আর শান্তিনিকেতনে অন্তত ১০ টি ফ্লাট এবং ৩টি বাড়ি তার নামে আছে বলে খবর। বিবেকানন্দ পল্লীর বাড়ির মালিক জানিয়েছেন, প্রায় ৫ বছর ধরে তিনি ওই বাড়িতে একাই থাকতেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় মাঝে মধ্যে সেখানে আসতেন তবে গত দু’সপ্তাহ ধরে মোনালিসা দাসকে ভাড়া বাড়িতে আর দেখা যায় নি।
আর, শনিবার সকালে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি) গ্রেফতার করেছে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি বেহালা পশ্চিম কেন্দ্র থেকে বিধানসভার সদস্য। কিন্তু এখনও এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাকে কিছুই জানানো হয় নি। এমনটাই জানিয়েছেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভার স্পিকার বলেছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিধানসভার সদস্য। শুনেছেন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে আইনত বিধানসভাকে জানানো উচিত। কিন্তু বিধানসভার সচিবালয়ে খবর নিয়ে জেনেছেন, ইডির তরফ থেকে এখনও কোনও চিঠি আসে নি।
তিনি আরও বলেছেন, বিধানসভার কোনও সদস্যকে গ্রেফতার করা হলে বিধানসভার সচিবালয় মারফত স্পিকারকে জানানো হয়। এ ক্ষেত্রে এখনও কোনও বার্তা পাঠায়নি ইডি।
প্রসঙ্গত, গত বছর মে মাসে সারদা কাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে মদন মিত্র, শোভন চট্টোপাধ্যায়-সহ রাজ্যের দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হয়। সে বার রাজ্যের এই প্রথম সারির রাজনীতিকদের গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। সেই সময় স্পিকার অভিযোগ করেছিলেন, তাঁকে কিছু না জানিয়েই বিধায়ক-মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আইন মানে নি সিবিআই।