Home Bangladesh রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর যে ৪ হাসপাতাল

রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর যে ৪ হাসপাতাল

148
0

স্বাস্থ্য অধিদফতরের আখ্যা দেওয়া ‘কঠিন জুলাই’ শেষ হয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, চলতি মাস (আগস্ট) ভয়ংকর হবে। কারণ ঈদের আগে শিথিল ও পরে লকডাউন দেওয়া হলেও পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় ফিরতে বলায় তারা ফিরছেন, যে কারণে সংক্রামণের ঝুঁকি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হবার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত মৃত্যুর কথাও জানায় তারা। সে থেকে দেশে এখন পর্যন্ত করোনাতে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হিসেবে মোট মারা গেছেন (৩১ জুলাই) ২০ হাজার ৬৮৫ জন।
বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটে বাংলাদেশেও দৈনিক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়ছে কয়েকগুণ। করোনার ঊর্ধ্বগতিতে চলতি মাসের দুই সপ্তাহ দেশে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। কিন্তু ঈদুল আজহা উপলক্ষে লকডাউন শিথিল করা হয়।
আর শিথিল লকডাউনের সুযোগে ঢাকা ছেড়ে গ্রামমুখী হয়েছে মানুষ। বাস, লঞ্চে, ফেরিতে গাদাগাদি করে গ্রামে ঈদ উৎসব করতে গিয়েছে সাধারণ মানুষ। আবার শিথিল লকডাউন শেষে কঠোর লকডাউনের আগে মানুষ যেভাবে ঢাকা ছেড়েছিল, ঠিক সেভাবেই ফিরেছে। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্যরা সে সময়ে বলছেন, শিথিলতার এ নির্দেশনায় তাদের ‘সায়’ ছিল না। তারা বলছেন, সরকারের শিথিল বিধিনিষেধের এ ঘোষণা তাদের পরামর্শের উল্টো চিত্র।
এসময় এ ধরনের শিথিলতা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ারই শামিল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিল, স্বাস্থ্য অধিদফতর যেখানে বার বার ভিড় এড়িয়ে চলার কথা বলছে, সেখানে সংক্রমণের ‘পিক টাইমে’ এ ধরনের ঘোষণা আমাদের আরও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাবে।
সে আশঙ্কাকে সত্যি করে দেশে ঈদের পর থেকে দৈনিক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর একের পর এক রেকর্ড দেখতে হচ্ছে দেশকে। কেবলমাত্র জুলাই মাসেই মারা গেছেন ছয় হাজার ১৮২ জন মানুষ আর শনাক্ত হয়েছেন তিন লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জন।
আর এতে করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা তালিকায় বিশ্বে এখন দিনে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হচ্ছে যেসব দেশে, সেই তালিকায় অষ্টম অবস্থানে বাংলাদেশ।
দেশে ঈদুল আজহার পর গত ৩০ জুলাই থেকে ঢাকামুখী হয়েছে মানুষ। সেখানে বিধিনিষেধে ফেরিতে যাত্রী পারাপার নিষিদ্ধ হলেও যাত্রীরা তা মানছেন না বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, বিধিনিষেধের আওতাভুক্ত যানবাহন পারাপারে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে মাত্র ছয়টি ফেরি চালু রাখা হয়েছে। জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিত যানবাহন পারাপারের সময় যাত্রীরা ফেরিতে ওঠে পড়েন। চেষ্টা করেও তাদের ফেরি থেকে নামানো যাচ্ছে না।
এদিকে, আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত লকডাউনের ঘোষণা থাকলেও দেশে ১ আগস্ট থেকে তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা চালুর ঘোষণায় শনিবার (৩১ জুলাই) সকাল থেকে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ফিরছে মানুষ। যেভাবে পারছে তারা ঢাকায় ফিরছে।
শিমুলিয়া ঘাটে আসা প্রতিটি লঞ্চে দেখা যায়, যাত্রীর গাদাগাদি। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে। সেখানেও উপেক্ষিত স্বাস্থ্যবিধি।
এদিকে, বাংলা ট্রিবিউনের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার প্রথম দিনে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। শ্রমিকরা দূর-দূরান্ত থেকে হেঁটে, অটো রিকশা, ইজিবাইক ও সিএনজিসহ বিভিন্ন যানবাহনে এসে রবিবার (১ আগস্ট) সকাল থেকে নিজ নিজ কর্মস্থল যোগ দেন।
কারখানার শ্রমিকরা বলছেন, তাদেরকে ঢাকায় ফিরে কাজে যোগ দিতে ফোন করে বলা হয়েছে। তাই কষ্ট করেও তারা ফিরছেন ঢাকায়।
অন্যদিকে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (১ আগস্ট) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ২৩১ জন। শনিবার (৩১ জুলাই) ছিল এ সংখ্যা ২১৮ জন। একদিনে মারা যাওয়া ২৩১ জনকে নিয়ে দেশে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট মারা গেছেন ২০ হাজার ৯১৬ জন।
একই সময়ে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৮৪৪ জন। এর আগের দিন শনাক্ত হয়েছিলেন ৯ হাজার ৩৬৯ জন। নতুন করে শনাক্ত হওয়া ১৪ হাজার ৮৪৪ জনকে নিয়ে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত হয়েছেন ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৮ জন।

আর এ অবস্থাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড অন্যতম বড় ৮ হাসপাতালেই আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই। মোট ১৭টি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হলেও তার মধ্যে তিনটি হাসপাতালে আইসিইউ নেই। বাকি হাসপাতালগুলোর মধ্যে মাত্র ১৬টি বেড ফাঁকা ছিল ১ আগস্ট (রবিবার)।

তবে সবচেয়ে ভয়ের কথা জানিয়ে অধিদফতর জানাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া চারটি বড় সরকারি হাসপাতালেই ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

অধিদফতর জানাচ্ছে, ১৭ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ বেড রয়েছে তিন হাজার ৯৩০টি। তার মধ্যে বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ৯২৪টি। এর মধ্যে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের নির্ধারিত সাধারণ বেড রয়েছে ১৬৯টি। তাতে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন চারজন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে বেড রয়েছে ২৭৫টি, তাতে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন ৭০ জন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৭০৫ বেডের বিপরীতে ভর্তি আছেন ৫৬ অতিরিক্ত রোগী আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৬৩ বেডের বিপরীতে ভর্তি আছেন ৫৪ জন অতিরিক্ত রোগী।

রাজধানী ঢাকার এই চার হাসপাতাল ছাড়া দেশের ১৫টি হাসপাতালে নির্ধারিত বেডের চেয়ে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছেন।

তবে সারাদেশে থেকে সাধারণত রোগীরা ছুটে আসছেন রাজধানীতে। তাতে করে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চাপ পড়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোগী সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে জানিয়েছেন, তারা হাসপাতাল তৈরির জন্য নতুন ভবন খুঁজছেন, কিন্তু সেটাও পাচ্ছেন না।

আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম হতাশা নিয়ে বলেন, হাসপাতালের বেডতো ‘রাবার’ নয় যে, টানতে টানতে বড় করা যাবে।

হাসপাতালের বেডের সীমাবদ্ধতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের বিছানা তো রাবার নয় যে, টানতে টানতে বড় হবে। বিছানা একটাও ফেলার জায়গা নেই, কোথায় আমি আর জায়গা দেবো।’

তারপরে তো শুধু কোভিড রোগী নয়, নন কোভিড রোগীরাও আছেন। তাদের সেবাও ব্যাহত হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক খুরশিদ আলম বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মতো এত বড় একটা হাসপাতালকে টোটালটাই কোভিড করে দিয়েছি, তাতে কি সামাল দেওয়া যাচ্ছে? আজ একটা বিছানাও খালি নেই। তাহলে রোগীর উৎপত্তিস্থল যদি বন্ধ করতে না পারি, তাহলে এটা করে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে বা অন্যান্য সুবিধা বাড়িয়ে খুব কি লাভ হবে?’
নির্ধারিত বেডের চেয়ে অতিরিক্ত রোগী রয়েছে হাসপাতালে, ৮০০ এর বেশি রোগী জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ৮১৭ জন রোগী রয়েছে এখন।
হিমশিম খাচ্ছি, তারপরও প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ জন রোগীকে ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছি- মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই বলছি সক্ষমতারও একটা লিমিটেশন থাকে।
‘এখন আর ওটা বলার মতো অবস্থা নেই’- বলেন দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক।
একই কথা জানিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেড বাড়িয়েছি, ৪০০ করেছি। তাতে করে কিছুটা জায়গা দেওয়া যাচ্ছে। ৫৯ জনকে ছুটি দিয়েছি আর ৬৬ জনকে ভর্তি করেছি।’
তবে বেড খুব বেশিদিন ফাঁকা থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বেড ফাঁকা থাকবে না। যে হারে মানুষ ঢাকা ছাড়লো, আর ফিরলো; তাতে করে অবস্থা ভয়ংকর হবে। এক থেকে দুই সপ্তাহ পরে এর প্রভাব বোঝা যাবে। এখনি হিমশিম খেতে হচ্ছে, তখন কী হবে বলা যাচ্ছে না।
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সেহাব উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হিমশিম খাচ্ছি। হাসপাতালের ওপরে ভীষণভাবে চাপ পড়ছে। আমরা জায়গা দিতে পারছি না, রোগীও বেশি আসছে। কিন্তু তাদের তো প্রয়োজন। অনেকের অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে বেশি। রোগী সামলাতে আউটডোরে অবজারভেশন ওয়ার্ডে অক্সিজেন দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে’।
আবার অনেককে ফেরতও পাঠাতে হচ্ছে জানিয়ে শিহাব উদ্দিন বলেন, এরপরও এক্সট্রা বেড করে ওভার অ্যাডমিশন দিতে হচ্ছে। হাসপাতালের ফাঁকা জায়গাতে কিছু বেড ফেলে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। হিমশিম খেতে হচ্ছে আসলে আমাদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here