১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের সৈন্য বাহিনী। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বিমান থেকে শেল ছোড়া শুরু করলে ভয় পেয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিগুণ উৎসাহে তখন একটার পর একটা অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে।
সেই সময়ে যৌথ বাহিনীর প্রতিটি অপারেশনের খবর কলকাতার পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো। স্বাধীনতার দলিলপত্রের চতুর্দশ খণ্ডে যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সংযুক্ত আছে। সেখানে বলা হচ্ছে—‘৬ ডিসেম্বর ছাপা হয়, ভারতের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানের বিমান হামলার সঙ্গে সঙ্গে ভারত এই সার্বিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর অ্যাকশন শুরু হলো। ৩ তারিখ মধ্যরাত থেকে ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর সন্ধি বিমানগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে আক্রমণ চালাতে লাগলো বাংলাদেশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে। প্রধান লক্ষ্য ছিল অবশ্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম। ঢাকা ছিল বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বিমান বাহিনী রাতে হামলা চালালো নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ঢাকার আকাশে চললো বিমান যুদ্ধ।
বাংলাদেশ-ভারতীয় বাহিনীর সাফল্যগুলোর মধ্যে ৬ তারিখে ফেনী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা জয় করে সন্ধ্যায় ভারতীয় বাহিনী লালমনিরহাট শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছায়। ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে এদিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও ঝিনাইদহে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি ও লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। স্থল বাহিনী ঝিনাইদহ যশোর রোড ধরে এগিয়ে কালিগঞ্জ দখল করেছে। কমান্ডের জনৈক মুখপাত্র কলকাতায় রাতে সাংবাদিকদের জানান, অসামরিক লোকদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে যশোরে ভারতীয় বাহিনী তাদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ রেখেছে। তবে তিনি পরিষ্কারভাবে জানান যে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের পালিয়ে যাবার কোনও পথ নেই। তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যুগান্তরে এই সংবাদ ছাপা হয়। পরদিন সকালে চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং জানান, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দখলদারি পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যদের যোগাযোগের সব সূত্র বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী খুলনার মোংলাবন্দরের কাছে পদ্মা (পশুর) নদীতে দুটি পাকিস্তানি গানবোট উড়িয়ে দিয়েছে। সাতক্ষীরা সেক্টরে মুক্তিবাহিনী তুমুল লড়াইয়ের পর সাতক্ষীরা শহরের প্রবেশ করেছে। সাতক্ষীরা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখন খুলনা রোড ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর বৈমানিকেরা প্রথম বিমান নিয়ে পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণ করে নির্বিঘ্নে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে এসেছেন।
বিমান বাহিনীর ভূমিকার কথা লিখতে গিয়ে বলা হচ্ছে, শিলং-এ ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের এয়ার মার্শাল দেওয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন যে কুমিল্লার ওপর ভারতীয় বিমান আরও একটি পাকিস্তানি জেট বিমানকে গুলিবিদ্ধ করে ভূপতিত করেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে দুটি পাকিস্তানি বিমান ধ্বংস করা হলো। এখন পর্যন্ত এই খণ্ডে ভারতের পাঁচটি বিমানের ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, ভারতের বিমান বাহিনী ১৮৬ বার আক্রমণ করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সামরিক লক্ষ্যবস্তু ও ঘাঁটিগুলো ক্ষতি করেছে। দিল্লিতে সরকারি মুখপাত্র জানান যে পাকিস্তানের দুটি বড় ট্যাংকারকে ভারতীয় নৌবাহিনী মেঘনা নদীর উপকূলে আটক করেছে। বিমানবাহীর নৌবহর খুলনার চালনা ও মোংলাবন্দরের লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আগরতলা অফিস থেকে অনিল ভট্টাচার্য জানান, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী আখাউড়া এবং কুমিল্লা জেলায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি ঘাঁটি অধিকার করায় আগরতলা এখন বিপদমুক্ত। ভারতীয় বাহিনী আগরতলার স্বল্প উত্তরে অবস্থিত ধর্মনগর ও জুড়ি রেলস্টেশন পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে পাক বাহিনীর সেরা দুর্গ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পাক বাহিনীর একাংশ চাঁদপুর চলে গিয়েছিল। এখন চাঁদপুর এবং ময়নামতির মধ্যে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পাক বাহিনী এখন ক্রমশ পিছু হটছে।
রাজধানী ঢাকার ভাটারা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক দেশে ভারতীয় বাহিনী প্রবেশের পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘৩ তারিখের পর প্লেন দিয়ে শেলিং শুরু হলে পাকিস্তানি সৈন্য ভয় পেয়ে যায়। চারপাশ স্থবির হয়ে যায়। শেলগুলো পড়ছে, দ্রিম দ্রিম শব্দ বাঙালিদের উৎসাহিত করে। শেলিংগুলো যখন হচ্ছে ব্যাপক শব্দ, ব্যাপক ধোঁয়া। সবার মনে আনন্দ। আর রক্ষা নাই, এখনই জয় হবে। ৩ তারিখের পর ইছাপুর বাজারে (বর্তমানে রূপগঞ্জ মেগাসিটি যেখানে) মুক্তিযোদ্ধারা এক জায়গায় হয়েছিল। আমরা ওই সময় ঘোড়াশাল কালিগঞ্জ গেছি। ওখানে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। পাকিস্তানিদের ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়েছিল। ক্রুকে গুলি করে মারে আমাদের দলের ফেরদৌস, সে পরে মেজর হয়। যুদ্ধকালে সে ক্লাস নাইনে পড়তো। চালককে মেরে ফেলায় তারা পিছিয়ে যায়। সে সময় প্লেন থেকে লিফলেট ছড়ানো হচ্ছিল— পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ করতে বলে। সে কী উৎসাহ। খবর পেয়ে আমরা ১৬ তারিখ সকালে ঢাকায় ঢুকে সরাসরি ক্যান্টনমেন্টে যাই। যেখানে সেখানে অস্ত্র পড়ে থাকতে দেখি। আমরা সেগুলো একসঙ্গে গরুর গাড়িতে করে যার যার বাসায় নিয়ে যাই এবং পরে থানায় জমা দেই।