তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি) দেশের পুঁজিবাজারে আসে ১৯৭৭ সালে। সুদীর্ঘ ৪৪ বছরে কোম্পানিটি ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণীয় হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এ কারণে পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির শেয়ার দরও বেশ চড়া। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ২০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে। এতে বিএটিবিসির উদ্যোক্তা রেলিগ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডসহ আরো কিছু স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীর কাগুজে শেয়ারের বিপরীতে আট কোটিরও বেশি বোনাস শেয়ার অপরিশোধিত লভ্যাংশ হিসেবে জমা হয়ে আছে। গতকালের শেয়ার দর অনুযায়ী এ শেয়ারের মূল্য ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কোম্পানিটির এ বিপুল অংকের অপরিশোধিত লভ্যাংশের বিষয়টি নিয়ে রহস্যের মধ্যে আছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারাসহ সংশ্লিষ্টরা।
শুধু বিএটিবিসি নয়, দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পুঞ্জীভূত অপরিশোধিত লভ্যাংশের বিষয়টি বেশ পুরনো। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে জমা পড়া হিসাব অনুসারে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অপরিশোধিত লভ্যাংশের মূল্য ২০ হাজার ৯৪২ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১০৩ টাকা। এর মধ্যে নগদ লভ্যাংশ ৯৫৬ কোটি ১০ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭ টাকা। আর স্টক লভ্যাংশের মূল্য ১৯ হাজার ৯৮৬ কোটি ২৮ লাখ ৮২ হাজার ৮৪৬ টাকা।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে অপরিশোধিত লভ্যাংশের দিক দিয়ে সবার শীর্ষে রয়েছে বিএটিবিসি। বর্তমানে কোম্পানিটির অপরিশোধিত নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ ৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর অপরিশোধিত স্টক লভ্যাংশ বা বোনাস শেয়ারের সংখ্যা ৮ কোটি ৯০ হাজার ৮৯৮টি, গতকালের শেয়ার দর অনুযায়ী যার বাজারমূল্য ১১ হাজার ৩৫৯ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ টাকা।
মূলত বিএটিবিসির বিপুল অংকের এ অপরিশোধিত লভ্যাংশ জমা হয়েছে ২০১৮ সালে ২০০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণার পর। স্টক লভ্যাংশ ঘোষণার আগে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬০ কোটি টাকা, আর শেয়ার সংখ্যা ছিল ছয় কোটি। স্টক লভ্যাংশ ঘোষণার পর কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা বেড়ে ১৮ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পরিশোধিত মূলধন ১৮০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
কোম্পানিটির ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া শেয়ারধারণ তথ্য অনুযায়ী বিএটিবিসির মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রেলিগ ইনভেস্টমেন্টের কাছে কোম্পানিটির ৭২ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এছাড়া বিদেশী করপোরেট বিনিয়োগকারীর কাছে ১৪ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, বাংলাদেশ সরকারের কাছে দশমিক ৬৪ শতাংশ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ, সাধারণ বীমা করপোরেশনের কাছে ২ দশমিক ৮২ শতাংশ, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) কাছে দশমিক ৩৩ শতাংশ, স্থানীয় করপোরেট বিনিয়োগকারীদের কাছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং বাকি ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে অন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে। এর মধ্যে রেলিগ ইনভেস্টমেন্টসহ স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ৪৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ শেয়ার কাগুজে, যা এখনো ডিম্যাট (ইলেকট্রনিক শেয়ারে রূপান্তর) করা হয়নি।
সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে কাগুজে শেয়ারের বিপরীতে স্টক লভ্যাংশ নেয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে লভ্যাংশ নিতে হলে শেয়ারকে ডিম্যাট করে তারপর বিও হিসাবের মাধ্যমে নিতে হবে। কিন্তু বিএটিবিসির উদ্যোক্তা রেলিগ ইনভেস্টমেন্টসহ আরো কিছু দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীর শেয়ারগুলো ডিম্যাট না করার কারণে এর বিপরীতে কোম্পানিটির কাছে বড় অংকের স্টক লভ্যাংশ জমা হয়ে আছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএটিবিসিকে কাগুজে শেয়ার ডিম্যাট করার জন্য একাধিকবার বলা হয়েছে। কিন্তু তারা এখনো ইলেকট্রনিক শেয়ারে রূপান্তর করেনি।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, সিকিউরিটিজ আইনানুসারে শেয়ার ডিম্যাট না করে স্টক লভ্যাংশ নিতে পারবে না। যতদিন শেয়ার ডিম্যাট না হচ্ছে, ততদিন এ ধরনের লভ্যাংশ কোম্পানির সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে জমা থাকবে। কমিশন সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। এখন থেকে অপরিশোধিত লভ্যাংশের বিষয়টি এ গাইডলাইন অনুসারে নিষ্পত্তি হবে। আর বর্তমানে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে কোম্পানির তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে শেয়ার ডিম্যাট করেই লেনদেনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অবশ্য শেয়ার ডিম্যাট না করার কারণে বিএটিবিসির অপরিশোধিত লভ্যাংশ দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত থাকার বিষয়টিকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন খোদ কমিশনের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, হয়তো কোম্পানির কর-সংক্রান্ত কোনো ইস্যু থাকতে পারে, যার কারণে তারা শেয়ারগুলোকে ডিম্যাট করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার শেয়ারগুলো ডিম্যাট করা হলে সেগুলো সহজে লেনদেনযোগ্য শেয়ারে পরিণত হবে। এতে করে পুঁজিবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের সরবরাহ বেড়ে যেতে পারে এবং এর প্রভাবে কোম্পানিটির শেয়ার দর কমারও আশঙ্কা রয়েছে। এটিও একটি কারণ হতে পারে শেয়ার ডিম্যাট না করার। তা নাহলে বিএটিবিসির মতো একটি কোম্পানি যারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সবসময়ই অগ্রগামী, সেই প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা কেন এ যুগে এসেও কাগুজে শেয়ার নিয়ে বসে থাকবেন, সেটি বোধগম্য নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএটিবিসির কোম্পানি সচিব ও হেড অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স মো. আজিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, কোম্পানি আইন ও সিকিউরিটিজ আইন মেনেই এতদিন পর্যন্ত অপরিশোধিত লভ্যাংশের বিষয়টি মেইনটেইন করা হয়েছে। কোনো শেয়ারহোল্ডার যদি স্বেচ্ছায় কাগুজে শেয়ারকে ডিম্যাট না করেন, তাহলে তো আর আমরা জোর করতে পারি না। আর আইনে কাগুজে শেয়ার রাখা যাবে না এ কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে লেনদেন করতে হলে কাগুজে শেয়ারকে ডিম্যাট করতে হবে। তবে এখন যেহেতু বিএসইসি এ বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি করেছে, সেহেতু তিন বছরের মধ্যে শেয়ার ডিম্যাট করার জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ওপর চাপ তৈরি হবে। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) অনুসারেই কেবল অপরিশোধিত নগদ লভ্যাংশের তথ্য আর্থিক প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে অপরিশোধিত লভ্যাংশ থাকার বিষয়টি নিয়ে সবাই অবগত থাকলেও এর প্রকৃত পরিমাণ কত, সে সম্পর্কে আগে কোনো ধারণা ছিল না নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জ কারোরই। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে পুঞ্জীভূত এ অপরিশোধিত লভ্যাংশের পরিমাণ নির্ণয়ের উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এজন্য দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অপরিশোধিত লভ্যাংশের তথ্য তলব করা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত বেশকিছু কোম্পানি এ তথ্য দেয়নি। তাছাড়া ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কাছে কী পরিমাণ অপরিশোধিত লভ্যাংশ রয়েছে, সে তথ্যও এখনো জানা যায়নি। অপরিশোধিত লভ্যাংশের যতটুকু তথ্য কমিশন পেয়েছে, তাতেই তা অবাক করার মতোই। কমিশনের পর্যবেক্ষণ, নগদ লভ্যাংশের অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলো তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। আর বিপুল পরিমাণ স্টক লভ্যাংশগুলো অপরিশোধিত থাকায় পুুঁজিবাজারে এগুলো লেনদেন হয়নি। এতে বাজারে শেয়ারের প্রবাহও কমে গেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো সুকৌশলে তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে অপরিশোধিত লভ্যাংশের তথ্যটি গোপন করে এসেছে।
কমিশন সূত্র বলছে, বিষয়টি নজরে আসার পর তারা এর পরিমাণ নির্ণয়ের পাশপাশি এ-সংক্রান্ত গাইডলাইন তৈরি করেছে কমিশন। প্রকৃত বিনিয়োগকারী কর্তৃক নগদ কিংবা স্টক লভ্যাংশ দাবি করার আগ পর্যন্ত একটি বিশেষ তহবিলের মাধ্যমে এটি পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতায় ব্যবহার করা হবে। এর ফলে এখন থেকে অপরিশোধিত লভ্যাংশ নিয়ে সব ধরনের অস্বচ্ছতা, তথ্য গোপন এবং অনিয়ম বন্ধ হবে বলে মনে করছে কমিশন।