ফাইজার বায়োটেকের এক লাখ ৬০২ ডোজ টিকা দেশে পৌঁছেছে। তবে অন্যান্য টিকার মতো এ টিকার ব্যবহার ও সংরক্ষণ পদ্ধতি আলাদা হওয়ায় এটি কোথায় ও কীভাবে দেওয়া হবে তা নিয়ে রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এ টিকা সংরক্ষণে সীমাবদ্ধতার কারণে পুরো দেশে দেওয়া যাবে না। এমনকি ঢাকার সব টিকাদান কেন্দ্রেও এটা যাবে না।
৭ জুনের পর সিদ্ধান্ত
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেকের তৈরি করোনাভাইরাসের এই টিকার ট্রেড-নাম ‘কমিরন্যাটি’। ২ জুন ফাইজারের টিকার সঙ্গে মিশ্রণ করার উপাদান ডাইলুয়েন্ট আসার ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কোভ্যাক্স থেকে এই ডাইলুয়েন্ট আনা হচ্ছে। যারা ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছেন, তাদের মধ্যে এই টিকা দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, টিকা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রশিক্ষণ শেষে তারিখ জানানো হবে। টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে অনেক হাসপাতাল বিবেচনায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংরক্ষণ যেভাবে হবে
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এই বিশেষ টিকা কেবল ঢাকাতেই সংরক্ষণ করা হবে। মাইনাস ৯০ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটা রাখতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ টিকার বড় চ্যালেঞ্জ সংরক্ষণ ব্যবস্থা। বাংলাদেশে যা অপ্রতুল। পরিবহনের জন্যও দরকার হবে থার্মাল শিপিং কনটেইনার বা আল্ট্রা ফ্রিজার ভ্যান। এ কারণেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা কঠিন হবে।’
ডা. শামসুল হক বলেন, ‘এর জন্য ফ্রিজার প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এ টিকা কন্টেইনারেই ড্রাই আইস দিয়ে পাঠানো হয়। বিমানবন্দর থেকে আমরা সেগুলো স্টোরে রাখবো।’
তবে এ অবস্থাতেও ফাইজারের দুই লাখ ডোজ টিকা সংরক্ষণ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। সক্ষমতা বাড়াতে পারলে ১০ লাখ ডোজও সংরক্ষণ করা যাবে বলে তিনি জানান।
সাধারণ রেফ্রিজারেটরে টিকাটি দুই ডিগ্রি থেকে আট ডিগ্রি তাপমাত্রায় পাঁচ দিন ও ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত ঠিক থাকবে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। আপাতত সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কেন্দ্রীয় হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে এটি।
মানুষের শরীরে প্রয়োগের আগে সাধারণ রেফ্রিজারেটরে দুই ডিগ্রি থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসে টিকার ভায়ালটি রাখা হবে ছয় ঘণ্টা। এতে এর উপাদানগুলো ধীরে ধীরে গলে যাবে। ওই অবস্থায় রাখা যাবে ১২০ ঘণ্টা। টিকা দেওয়ার দিন সেটা হিমাগার থেকে টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে, বলেন ডা. শামসুল হক।
তিনি জানান, কেন্দ্রে নেওয়ার পর ডাইলুয়েন্টের সঙ্গে মিশিয়ে এই টিকা মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। ডাইলুয়েন্ট মেশানোর পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে টিকা প্রয়োগ করে ফেলতে হবে।
পরীক্ষামূলক প্রয়োগে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা দেখানো ফাইজারের টিকাও নিতে হবে দুই ডোজ করে। প্রথম ডোজ দেওয়ার তিন থেকে চার সপ্তাহ পর দিতে হবে দ্বিতীয় ডোজ। শুধু ১২ বছরের বেশি বয়সীরাই এ টিকা নিতে পারবে।
ডা. শামসুল হক বলেন, প্রায় আট থেকে ১০ লাখ ডোজ টিকা রাখার মতো ফ্রিজারের ব্যবস্থা আমরা হয়তো করতে পারবো। যেগুলো এখন অন্য কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
কোথায় ও কাদের দেওয়া হবে
অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, টিকা কোথায় ও কাদের দেওয়া হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। এই টিকা যাতে কোনও অবস্থাতেই নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। যেহেতু টিকার পরিমাণ কম, তাই যারা ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করেছেন তাদেরই টিকাটি দেওয়া হবে।
তবে আপাতত এই টিকা আমরা ঢাকাতেই দেবো জানিয়ে ডা. শামসুল হক বলেন, ঢাকার সব সেন্টারে দেওয়া যাবে না। সব সেন্টার টিকাটি রাখার উপযুক্ত নয়।
ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে
‘যেহেতু এটা বিশেষ ধরনের ভ্যাকসিন, তাই বেশ কিছু নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে’- বলেন ডা. শামসুল হক। তিনি আরও বলেন, ‘এটা ছয় ডোজ ভায়ালের টিকা। একটি কেন্দ্রে আমরা তখনই ভ্যাকসিন দিতে পারবো যখনই দেখবো, অন্তত ছয় জন মানুষ উপস্থিত আছেন। চার জন আছেন, দুই জন নেই, তখন টিকা দেওয়া যাবে না। তাতে ওয়েস্টেজ হয়ে যাবে।’
কিন্তু অনেকেই বলেন, আরেকজন আসেনি বলে আমি ফেরত যাব নাকি? কিন্তু এটা বুঝতে হবে, এমনটা হলে আরেকজন করোনার টিকা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সবাইকে টিকাদান কেন্দ্রে এসে ধৈর্য্য ধরতে হবে। এই অনুরোধটা সবাইকে করতে চাই, বলেন ডা. শামসুল হক।
আবার একইসঙ্গে কেন্দ্রে এসে তাড়াহুড়ো করা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা যেহেতু টেম্পারেচার সেনসিটিভ, তাই আগে থেকে রেডি করে রাখা যায় না। এটা রেডি করতেও ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগবে।’
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারটি করোনাভাইরাসের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করে। পরদিন (২৫ মে) অধিদফতর ভ্যাকসিনটির ডোসিয়ার (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পার্ট, সিএমসি পার্ট এবং রেগুলেটরি স্ট্যাটাস) মূল্যায়ন করে এ সংক্রান্ত গঠিত কমিটির মতামতের জন্য উপস্থাপন করে।
ভ্যাকসিন বিষয়ক কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।
এর আগে দেশে ৭ জানুয়ারি অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড, ২৪ এপ্রিল রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এবং ২৯ এপ্রিল চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয় সরকার।
দরিদ্র দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিতে গঠিত আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (গ্যাভি) কাছ থেকে ফাইজারের এ টিকার চালান আসছে। বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৯২টি দেশকে করোনাভাইরাসের টিকা সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে গ্যাভি। দরিদ্র দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে গঠন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম কোভ্যাক্স তথা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস ফ্যাসিলিটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ছাড়াও উদ্যোগটির সঙ্গে রয়েছে কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন ও দাতব্য সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (জিএভিআই)। এ উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে, ভ্যাকসিন মজুত করে না রেখে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সর্বোচ্চ ঝুঁকির দেশগুলোতে তা বণ্টন করার জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় ১৩ কোটির বেশি মানুষকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। কোভ্যাক্স থেকে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ।
চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিশ্বজুড়ে টিকার সংকট তৈরি হওয়ায় তা পিছিয়ে যায়।