শুরুতে মাসে ২৫ লাখ, এরপর ৫০ লাখ। এবার মাসে এক কোটি বা তারও বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর তাতে করে দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার পরিধি আরও বাড়ছে। বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনায় এবার ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়া, টিকার বয়সসীমা কমিয়ে আনাসহ নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। সঙ্গে দেশে আসতে শুরু করেছে থেমে থাকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও।
দেশে আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে সরকার।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- একেবারে গ্রাম পর্যায়ে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। সেখানে আইডি কার্ড দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে সরাসরি টিকা নিতে পারবেন সাধারণ মানুষ।
করোনাভাইরাস থেকে সবার সুরক্ষিত থাকা দরকার জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইতোমধ্যে টিকা যেখানে যা পাওয়া যাচ্ছে তা আমরা কিনছি। তার জন্য টাকাও রাখা আছে। প্রয়োজনে আরও টাকা খরচ করবো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক যারা টিকা নিতে পারবে, তারা সবাই যাতে টিকা নিতে পারে সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। ইতোমধ্যে ১ কোটি ৮৭ লাখের কাছাকাছি টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। আমরা আরও টিকা দিচ্ছি।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, গণটিকাদান কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী সাত আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচির জন্য সব কাজ সম্পন্ন করে আনছেন তারা।
ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হতে যাচ্ছে। আর এ বিষয়ে প্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ চলছে।
সারাদেশের বিভাগগুলোতে বিভিন্ন ব্লক করে অনলাইনে প্রশিক্ষণ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী ছয় আগস্ট পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলবে। আর সেদিনেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন বলেও জানান তিনি। সেদিনই এ বিষয়ে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, টিকা পেতে সরকারি অনলাইন নিবন্ধন প্ল্যাটফর্ম সুরক্ষা ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করার বাইরেও জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ঢাকার বাইরে গ্রাম পর্যায়ে কোনও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, কিছুটাতো হতেই পারে।
তবে এজন্য স্থানীয় সরকার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তা চেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর- জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও ইনভল্ব করেছি। আর এজন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশের মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি মিটিং করবেন- এমন একটি পরিকল্পনা রয়েছে’।
তবে এখানে সবার সহযোগিতা লাগবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেবল আইন প্রয়োগকারী লোকদের দিয়েতো হবে না। কারণ, জনপ্রতিনিধিরা ইনভল্ব না হলে সমস্যা হতেই পারে।
এক কোটি টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু এত পরিমাণ টিকা দেশে আসবে কিনা প্রশ্নে অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, আমরা প্ল্যান করে রেখেছি, কিন্তু প্ল্যান প্রতি মুহূর্তেই বদলাবে টিকা পাওয়ার সাপেক্ষে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মত দেশে যদি প্ল্যান না করে রাখি, তাহলে তো কাজ করা যাবে না। আর প্ল্যান তো ফিক্সড কিছু না। আমরা মনে করি, প্ল্যান প্রতি মুহূর্তেই কাস্টমাইজড করা হবে কতটুকু পাওয়া গেল, কত বুথে টিকা দেওয়া যাবে- সবকিছুর ওপর’।
হয়তো কোনও ব্লকে টিকা দেওয়ার জন্য ১৬ জন কর্মী রয়েছেন, কিন্তু ১৬ জনই অসুস্থ হয়ে গেল- তাহলে তখন কী হবে? এটা হতেই পারে জানিয়ে স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বলেন, ‘সেজন্যই আমরা পরিকল্পনা করে রেখেছি, যখন যেভাবে টিকা আসবে, সেভাবে আমরা কাজ করবো। তবে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, মাসে এক কোটির অধিক টিকা দেওয়া। তা না হলে আমরা সারাদেশকে কাভারে আনতে পারবো না’।
দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে…সেটাই করতে হবে বলেন অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম।
এদিকে, ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকাদানের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর নির্দেশনা পাঠিয়েছে।
অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের টিকাদান নিয়ে একেবারে একটি মাইক্রো প্ল্যান ঠিক করা হয়েছে। সে অনুযায়ীই কাজ হবে। সবাইকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা হলেও সেখানে ৫০ বছরের বেশি নারী এবং পুরুষদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আর সকাল নয়টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে।
টিকাকেন্দ্রের স্থান ঠিক করবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে। তবে কমিউনিটি ক্লিনিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের মত স্থানগুলোকে টিকাকেন্দ্র করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে সাড়ে চার হাজারের মতো বা তারও বেশি টিকাকেন্দ্র হবে। একইসঙ্গে পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে আর সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি করে কেন্দ্র করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ডা. শামসুল হক বলেন, সপ্তাহে তিন দিন টিকা দেওয়া হবে। কেন্দ্রগুলোতে দুজন থাকবেন টিকা দেওয়ার জন্য আর তিনজন ভলান্টিয়ার থাকবেন। তারাই টিকাদানের প্রতিদিনের কার্যক্রম মনিটর করবেন।
বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি যেখানে মিলে যায়, সেখানে বিজ্ঞান বলছে বেশি বয়সী-অসুস্থ-গর্ভবতী নারী এবং ঝুঁকিগ্রস্ত যারা তাদের টিকা দিলে মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কমবে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান খসরু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারণ প্রোটেকশন তাদের বেশি দরকার। একইসঙ্গে দেশের সংস্কৃতি বলে, আমাদের অভিভাবক অথবা অসুস্থদের আগে খাবার দিই অথবা ভালো ঘরটা দিই ঘুমানোর জন্য। অতএব বর্তমানে এই যে ২৫ বা ৩০ বছর টিকার জন্য বয়স কমানো হয়েছে, এটা কমানো হোক। রেজিস্ট্রেশন হোক। কিন্তু সর্বস্তরে যেন এই সংস্কৃতি বহাল থাকে, যেহেতু এটা বিজ্ঞানের সঙ্গে মানানসই’।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, একটি ইউনিয়নে ৬০ বছরের কাউকে বাদ দিয়ে যেন ৫০ বছর বয়সীদের টিকা না দেওয়া হয় জ্ঞানত। কেউ অসুস্থ হয়ে ঘরে থাকলে যেন তাকে অন্তত টিকাদান কেন্দ্রে এনে টিকা দেওয়া হয়। গর্ভবতী এবং যেসব মায়েরা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাদেরকে টিকা দেওয়া হোক। এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে।
অগ্রাধিকার যদি বদলে যায়, কেবল সংখ্যায় ভ্যাকসিন কাভার করলে কিন্তু তেমন বড় কোনও অগ্রগতি হবে না- বলেন তিনি।
‘যারা তরুণ তাদের তুলনায় বৃদ্ধ এবং অসুস্থদের কেউ আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা চার থেকে পাঁচগুণ বা কোথাও কোথাও আটগুণ বেশি থাকে বয়স্ক মানুষটির। তাই এবারে যখনি টিকাদান কর্মসূচি সম্প্রসারিত হবে সেখানে ঝুঁকিগ্রস্ত যারা বয়স-রোগ-প্রসূতি এবং দুগ্ধ দানকারী- এই চার গ্রুপ, যারা ঝুঁকিগ্রস্ত তাদেরকে টিকা দেওয়ার বিষয়ে স্থানীয় প্রতিনিধিরা যেন খুঁজে খুঁজে এনে টিকা দেন।’
আর নারীরা যে টিকাদানে পিছিয়ে গেছে- এবারের টিকাদানে যেন সেটা কাভার করার জন্য নজর থাকে বলেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।